ডা. শাহনূর শারমিন মুন্নী

ডা. শাহনূর শারমিন মুন্নী

সহযোগী অধ্যাপক, 
মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ


২৭ এপ্রিল, ২০২৩ ১২:৪৪ পিএম

সুস্থতার ঐশ্বর্যের মাঝেও অতৃপ্তি-অনুযোগে পূর্ণ জীবন 

সুস্থতার ঐশ্বর্যের মাঝেও অতৃপ্তি-অনুযোগে পূর্ণ জীবন 
কতো কতো অসুখ আছে, যেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো একেবারেই অসহায়। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা—একেবারেই মূল্যহীন। শুধু অসহায় অপেক্ষা শেষ পরিণতির জন্য।

সেই কত বছর আগের কথা! এক ভরদুপুরে আমি আর রাব্বানী, মানে আমার রিডিং পার্টনার, গিয়ে হাজির হয়েছি পিজি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে। উদ্দেশ্যে এমআরসিপির জন্য রোগী দেখা। 

এক বিছানার কাছে গিয়ে দুইজন আলোচনা করতে করতেই চোখ চলে গেলো দূরের একটা শয্যায়। বছর সতেরো-আঠারোর এক ভীষণ মিষ্টি চেহারার ছেলে শুয়ে আছে, পাশেই মলিন মুখে বসা তার মা। ছেলেটি শোয়া অবস্থা থেকে ওঠার চেষ্টা করতেই আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো! এই দেহভঙ্গি আমার খুব পরিচিত। আমি ধড়ফড় করে সেখানে গিয়ে কাগজপত্র উল্টে-পাল্টে দেখে বুঝলাম, যা ভেবেছি, তাই। 

শান্তনু নামের ছেলেটি এক বিরল জিনঘটিত রোগে আক্রান্ত! রোগের নাম ডুশিন মাসকুলার ডিস্ট্রফি, সংক্ষেপে ডিএমডি! এই রোগে ধীরে ধীরে শরীরের মাংসপেশী নষ্ট হয়ে যায়, এক সময় গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মাংসপেশী কর্মক্ষমতা হারিয়ে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বিজ্ঞানের এই জয় জয়কারের সময়েও এর কোনো চিকিৎসা নেই। এই রোগী সাধারণত পনেরো থেকে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কি ভীষণ কষ্টকর অবস্থা! পৃথিবীর সকল ধন সম্পদ এনে দিলেও কোনো আশার আলো কেউ দেখাতে পারে না। আপনজনের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে শরীর অবশ হয়ে এক সময় অন্তিম যাত্রায় পা বাড়ায় রোগী।

সেই দিন শান্তনু আর তার মায়ের সাথে অনেক কথা বলেছিলাম। দেখেছিলাম, খুব কাছে এগিয়ে আসা মৃত্যুর ছোবল থেকে বাঁচার জন্য কি বিফল আকুতি! এখনো আমার চোখে ভাসে এক মায়ের আর্তনাদ! আমার হাত চেপে ধরে বলছেন, ম্যাডাম, কোন দেশে গেলে, কতো টাকা হলে আমার ছেলেকে সুস্থ করা যাবে? আমি সব কিছু বেচে, ভিক্ষে করে হলেও তা জোগাড় করবো।

এর অনেক বছর পরে, সেদিন দুসাই রিসোর্টে গিয়ে সিনেপ্লেক্সে সিনেমার তালিকায় দেখতে পেলাম 'সালাম ভিংকি' নামটি। প্রিয় নায়িকা কাজল আছে বলেই দেখতে বসে গেলাম। একটা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে কাহিনি, যেখানে সুজাতা মানে কাজল তার ছেলে ভেংকটেশকে নিয়ে লড়াই করে এই বিরল রোগের বিরুদ্ধে। 

ছোট বেলাতেই বাবা কন্যাটিকে নিজের কাছে রেখে মা আর রুগ্ন  ছেলেকে বের করে দেন। ভিংকি, এক অসম্ভব প্রাণচঞ্চল ছেলে, চব্বিশ বছরে পড়েছে, এবং একেবারেই শয্যাশায়ী। সে জানে তার অমোঘ পরিণতির কথা, সে দেখে তার একা মায়ের সংগ্রাম এবং বিষাদ। তার চাওয়া একটাই, স্বেচ্ছামৃত্যু, যাকে বলা হয় ইউথানাসিয়া। তাতে করে, তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সে দান করে যেতে পারবে অন্যদের জীবন রক্ষার্থে। 

সুজাতা এতে কিছুতেই রাজি হয় না প্রথমে, পরে ছেলের আগ্রহে সে এতে সায় দেয়। কিন্তু আইনগতভাবে নিয়ম না থাকায় চিকিৎসক, আইনজীবী আর সুজাতার আরেক লড়াই শুরু হয়, স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমোদনের জন্য লড়াই। 

পুরো ছবিতে ভেংকটেশের যে বাঁচার আকুতি, চলে যেতে হবে জেনেও ভালো কিছু করার ইচ্ছে, সুজাতার নিজ সন্তানের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাক্ষী হওয়ার অসম্ভব যন্ত্রণা, সবকিছু মিলিয়ে দারুণ একটা নির্মাণ। এখানে আমির খান আছেন ছোট্ট একটা চরিত্রে, আছে একটা অসম্ভব মিষ্টি মেয়ে, দৃষ্টিশক্তিহীন, কিন্তু অসম্ভব মায়া ভিংকির প্রতি।

এক নিঃশ্বাসে পুরো সিনেমাটি দেখলাম। মনে পড়ে গেলো, অনেক অনেক আগের সেই দুপুরের কথা। ভাবলাম, রোগের কাছে আসলেই কতো অসহায় আমরা! এ রকম কতো কতো অসুখ আছে, যেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো একেবারেই অসহায়। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা—একেবারেই মূল্যহীন। শুধু অসহায় অপেক্ষা শেষ পরিণতির জন্য।

যারা সুস্থ আছেন, তারা হয়তো বুঝতেও পারেন না, কি অসম্ভব সৌভাগ্য বহন করে চলেছেন তারা। শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা আসলেই একটা স্বর্গীয় ব্যাপার। তাও আমরা কতো রকম অতৃপ্তি আর অনুযোগ, অভিযোগে পার করে দেই আমাদের ছোট্ট জীবন।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
২৭তম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় দিবস 

স্বাস্থ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনাই হোক বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অঙ্গীকার

২৭তম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় দিবস 

স্বাস্থ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনাই হোক বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অঙ্গীকার

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত